শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৬ অপরাহ্ন
☂️দাদার স্মৃতি……
দাদা, জন্মদাতা বাবার বাবা। আমি যখন সদ্য কৈশোর পেরিয়ে ভরা তারুণ্যে সেবছর ইন্তেকাল করেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় দাদাজান
শেখ সুফি আব্দুল লতিফ (রহমাতুল্লাহি আ’লাইহি) সালটা ছিলো ১৯৯৮ এর ২৬ অক্টোবর তাহাজ্জুদের সময় ভোর ৪ টার দিকে হবে সম্ভবত।
হলিফ্যামেলি হাসপাতাল, ঢাকা।
🌺শিয়রের কাছে ছিলেন, দাদার মেঝো সন্তান আমাদের পিতা শেখ আমিনুল ইসলাম (রহ) এবং সেজো চাচু শেখ আবুল হাসান চানু।
গ্রামে খবর জানাতে হবে, কার মাধ্যমে জানানো যায়।
☎️বরিশালে বড় মামা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বাসায় টেলিফোনে সংবাদ জানানো হয়।
সময়টা টেলিফোনের যুগ, মোবাইল সবেমাত্র শুরু হয়েছে ঢাকার অভিজাত পাড়ায়।
🔖দাদার মৃত্য সংবাদ বাহক ছিলেন আমার অনুজ মামাতো ভাই বরিশাল নিবাসী মাওলানা মুফতি আল আমিন। কবর খোড়া থেকে দাফন পর্যন্ত “ও” সাথেই ছিলো অকুন্ঠচিত্তে।
🚒কাফন ও জানাজার আনুষ্ঠানিকতা শেষে চাচা-ফুপুদের বহর নিয়ে মাওয়া হয়ে ঝালকাঠির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
মাওয়া ফেরীতে জোহরের সালাত আদায়, টেকেরহাটের পরে সড়কতীরে ছোট এক মসজিদে আসরের সালাত আদায়, আবারও যাত্রা তিতাস গ্যাসের পিকআপ ভ্যানে উন্মুক্ত ইথারের স্নিগ্ধ সমীরণে।
🏡এ’শার আযানের অল্প পরে নলছিটির শ্রীরামপুর আমাদের মরহুম দাদাকে নিয়ে পৌছে যাই। আগে থেকেই শ্রীরামপুর ছোট ব্রীজের নীচে ট্রলার বাঁধা
ছিলো,
সেই ট্রলারে করেই দাদার কফিনসহ আমরা পৌছে যাই দেড় কিলোমিটার দূরের খাওক্ষীর গ্রামে।
বাড়ীর উঠানে নামাজে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় আমাদের পরম প্রিয় আদর্শিক আইকন দাদাকে।
📠তখন তো টেলিফোনের যুগ, মোবাইল সবেমাত্র শুরু হয়েছে ঢাকার অভিজাত পাড়ায়। দাদার মৃত্য সংবাদ বাহক ছিলো বরিশাল নিবাসী আমার মামাতো ভাই মাওলানা মুফতি আল আমিন, কবর খোড়া থেকে দাফন পর্যন্ত “ও” সাথেই ছিলো।
🚒দাদার লাশবাহী তিতাসের পিকআপ ড্রাইভার আনোয়ার সাহেবের অনুভূতিঃ
“জীবনে অনেক লাশ পরিবহন করেছি কিন্তু এতো দ্রুত গতিতে লাশের গাড়ি চলতে দেখিনি।
অধিকাংশ লাশ পরিবহনে মনে হতো, পেছন থেকে কে যেন গাড়ি টেনে ধরেছে। নিঃসন্দেহে তিনি খুব পরহেজগার মানুষ ছিলেন।”
(আনোয়ার ড্রাইভার ক’য়েক মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন, আল্লাহ তাঁর কবরকে মুনাওয়ার করে দিন, আমীন)
সত্যিই আমাদের দাদাজান অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ ছিলেন, তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য নফল ইবাদত খুব যতনে আদায় করতেন।
🦐১৯৭৮/৭৯ সালের ঘটনা, আমি তখন ভালোই হাটতে পারি, কথাও বলতে পারি। আমার মহিয়ষী দাদী মরহুমা (২মার্চ ২০০৭) হালিমা খাতুনের মুখে বড় হয়ে শুনেছি, দাদা প্রায় দিনই বিকেলে “কালিজিরা নদী” তে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যেতেন,
ভালোই মাছ পেতেন কিন্তু যেদিন আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন সেদিন নাকি “আইর, বোয়াল” কিংবা বড় কোন মাছ পেতেন। দাদির কাছে এ কথা শুনে সত্যিই নিজকে খুব ভাগ্যবান বলে মনে করে পুলোকিত হতাম।
🧤কালিজিরা নদীর “দড়িটানা ফেরী”।
আশির দশকের সম্ভবত মাঝামাঝি প্রাইমারী স্কুল ছুটি, দাদা এলেন ঢাকা বেড়াতে দিন দশেক থেকে যাবার পথে দাদার সফরসঙ্গী হলাম পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার খাওক্ষীর গ্রামে।
🛳️যাত্রাপথে সদরঘাট থেকে লঞ্চে বরিশাল নৌবন্দর।
রিকশা যোগে কালিজিরা নদীর ঘাট, “দড়িটানা ফেরী” তে চড়ে নদী পার হয়ে আবারো রিকশা কিংবা টেম্পো যাত্রা গন্তব্য আমাদের গ্রাম।
দিন-রাত সে-কী যত্ন আত্নী, কি খাব? কতটুকো খাবো? কেন খাইনা? মমতার বাধনে আকড়ে রাখেন তিনি আমার দাদা।
🍧তুলনাহীন মেহমানদারী দেখেছি দাদার বৃদ্ধ জীবনেও। শীত কিংবা গৃষ্মে প্রাতঃভ্রমণ শেষে গ্রামের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ দাদার আতিথেয়তা গ্রহন করতেন নিঃসঙ্কো চিত্তে।
🍵দুধ-চা কখনো আদা- চা’র সাথে মুড়ি-খই, বিস্কুট অথবা চালভাজা।
মাঝে মধ্যে শিশির ভেজা শৈতালী মাঘের কনকনে সকালে বিশেষ আয়োজনে বাড়ীর খেজুর গাছের ঝোলগুড় দিয়ে চিতই পিঠা কিংবা ভাপা-পুলি পায়েশের সাথে দ্বীন তরবিয়তী কথা, নীতিকথার অনিন্দ্য বয়ান।
🍮 হাটের দিন বাজারে যাবার উৎসব সে কী আনন্দ। সপ্তাহের কোন বারে কোথায় হাট বসে, কোন হাটের মুখরোচক খাবার আইটেম খেতে কেমন? তা যেন হৃদয়ঙ্গম অহর্নিশ।
✂️ঢাকা থেকে বাবা-মার সাথে যখনই গ্রামে যাওয়া হতো, মাসে একদিন বাড়ীতে নাপিত ডেকে সকল নাতিদের চুল কাটানো ছিল দাদার অন্যতম রুটিন দায়িত্ব।
নাপিত মশাই জলজকিতে বসে আমাদেরকে পিড়িতে বসিয়ে তার দু’হাটুর মাঝখানে মাথা ঢুকিয়ে আটকে রেখে চুল কাটতেন, সে এক অনন্য স্মৃতি যা ভোলার নয় কোনদিন।
🐂 কোরবানি উপলক্ষ্যে যখনই গ্রামে গিয়েছি, প্রতিবারই দাদার সাথে গরু কেনার জন্য নৌকায় চড়ে সুগন্ধিয়া হাটে যেতাম।
গরুরহাটের অস্থির পরিবেশেও দাদা কখনো হাত ছাড়েননি, যদি হারিয়ে যাই কিংবা কোন দুর্ঘটনা ঘটে, বৃদ্ধ বয়সেও কতটা দায়িত্ববান ছিলেন আমাদের দাদা।
দুপুরে খেয়ে নৌকা ভ্রমন, গ্রামের দাদা-চাচাদের সাথে, কত যে আনন্দ।
🐂কখনো গরু নিয়ে চাঁদনী রাতে বাড়ী ফেরা হতো দাদার হাতধরে গ্রামীণ মোঠো পথ মাড়িয়ে, আবার কখনো মন ভেঙ্গে যেতো গরু পছন্দ না হওয়ায়। কিশোর মনে যা হয়।
🐠নৈতিক শিক্ষার হাতেখড়িঃ
ডেমরার বাড়ীতে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময়ের একটি ঘটনা, সময়টা ১৯৮৫/৮৬ সালের কথা। প্রতিদিন বাদজোহর সালাত শেষে দুপুরের খাবার আয়োজন করা আমার রুটিন দায়িত্ব ছিলো।
একসাথে দাদার সাথে খাচ্ছি আর মাছ খেয়ে কাটাগুলো “চিলুমচি”র পানিতে ফেলে দিচ্ছি তৎখনিক দাদা বল্লেন,
“দাদাভাই মাছ খাওয়াটা তোমার অধিকার এবং মাছের কাটা খাওয়াটা বিড়ালের অধিকার। তুমিতো বিড়ালের হক্ব নষ্ট করতে পারোনা।
ফি সাবিলিল্লাহ বলে দেয়ালের এক কোনে ফেলে দাও। যে প্রাণীই খাকনা কেন, তোমার ছাওয়াব হয়ে যাবে”।
এরপরে আর কোন দিন কাটা পানিতে ফেলে দেইনি। চেষ্টাকরি প্রাণীর হক্ব আদায় করতে। চেষ্টা করছি সন্তানকেও শেখাতে “সদক্বায়ে জারিয়া”।
🌹১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় গোটা দেশ প্লাবিত, দেশের কম সংখ্যক জেলার সাথেই রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ছিলো। কিছুদিন হলো তিতাস গ্যাস কর্মকর্তা ছোট চাচু
(আবুল হোসেন) সদ্য পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ সত্ত্বা, হাড়ি-পাতিল, পুটলি-পাটলি নিয়ে সংসার পেতেছেন ঘোড়াশালের পলাশ উপজেলার তিতাস কোয়াটারের দোতলায়। সড়ক পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বিকল্প পথের চিন্তা।
🌈১৯৮৮’র বন্যায় নৌভ্রমণ ডেমরা-ঘোড়াশালঃ
ডেমরা ঘাট থেকে ট্রলারে রূপগঞ্জের কাঞ্চন হয়ে সকাল দশটায় রওনা দিয়ে সারাদিন বন্যা প্লাবিত নদী তীরবর্তী জনপদের ভাসমান জীবনযাত্রার করুন চিত্র স্মৃতিপটে ধারণ করে,
রুটি-কলায় দুপুরে উদর পুরে বিকেল পাঁচা নাগাদ শীতলক্ষ্যার পলাশ ঘাটে নেমে রিকশায় তিতাস কোয়ার্টার পৌছি মাগরিব নাগাদ।
সারাদিনের ঘর্মাক্ত শব্দদূষনময় নৌভ্রমণের পরিসমাপ্তি হলো দাদার সাহসী উদ্যোগে।
⛱️ ট্রেনের টয়লেটে ভ্রমনঃ
৪/৫ দিন থেকে আবার ঢাকা ফেরার পালা, রিকশা-ভ্যানে চেপে ঘোড়াশাল রেলস্টেশন, ঘন্টাদেড়েক অপেক্ষা। ট্রেন এলো কিন্তু উঠবো কেমন করে? হাজারো মানুষের ঢাকামুখী যাত্রা।
সৌভাগ্য ক্রমে জনস্রতের ধাক্কায় ট্রেনে উঠতে পারলাম কিন্তু আরো দু’জনের সাথে আমার আর দাদার স্থান হলো ট্রেনের “টয়লেটে”।
জীবনে প্রথম ট্রেনযাত্রা তাও আবার টয়লেটে। কিশোর বয়সে এ এক অনবদ্য প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে, যা কোনদিন ভোলার নয়।
📕 রাত জেগে সাইমুম সিরিজ, দৈনিক পত্রিকা পড়া, কুরআন তেলাওয়াত ছিলো দাদার রুটিন ওয়ার্ক।
সবুজ কখনো কালো পাগড়ী পরে ফরজ সালাত আদায় করতেন মসজিদে কিংবা বাড়ীতে, পারোত পক্ষে জামা’য়াত ছাড়তেন না।
🌹দাদা ছিলেন ছারছীনার প্রথম পীর মাওলানা নেছারউদ্দীন আহমাদ (রহ) এর মুরিদ।
আমাদের গ্রাম থেকে শুষ্ক মৌসুমে গ্রামীণ মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে
দাদা ছারছীনার বাৎসরিক মাহফিলে শামিল হতেন, প্রায় ২০ মাইল পথ পায়ে হেটে আবার কখনো নৌকা যোগে, শুনেছি দাদার মুখে।
🔎সম্ভবত দাদার বয়স হয়েছিলো ৯০ বছর। এ বয়সে এসেও দাদা মনের দিক দিয়ে ঝরঝরে তরতাজা সতেজ প্রাণ যুবক ছিলেন।
একাকি ঝালকাঠির গ্রামের বাড়ী থেকে বরিশাল হয়ে ঢাকার সদরঘাট নেমে রিকশা করে গুলিস্তান এসে আদমজীর বাসে চড়ে
সারুলিয়া বাজার নেমে বস্কা-বেডিংসহ শ্রমিকের সাহায্য নিতেন।
যখন পায়ের রিকশা চালু হলো ১৯৮৮ সালে তখন রিকশায় চড়ে আমাদের আইডিয়াল রোডের বাড়ীতে বেড়াতে আসতেন। ১৯৮২ সালে এই বাড়ীর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন দাদার আদর মাখা হাতেই হয়, আমি তখন তাঁর পাশেই আব্বুজির হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ষ্পষ্ট মনে আছে।
🍒আমরা ভাই-বোনরা চাতক পাখীর মতো তাকিয়ে থাকতাম, কবে দাদা আসবেন, দাদার ব্যাগে গ্রামের বাড়ীর নানান ফল-ফলাদি কিংবা পিঠাপুলির হরেক ব্যঞ্জনা।
দাদার আদরে-আহলাদে বাধনহারা সময়পার, তদুপরি বাবা-মা’র শাসনের মাত্রা শূন্যের কোটায় নেমে আসা বাড়তি প্রাপ্তি। তাই এখন বুঝি আমার সন্তানেরা কেনইবা এতো নানু-দাদুর জন্য ব্যাকুল প্রাণ।
⛱️আজ ২৩ বছর শেষ হলো, দাদা আমাদের মাঝে নেই। সে বার ৫দিন গ্রামের বাড়ীতে দাদার অধস্তন প্রজন্মের ৭ সন্তানের ঘরে ২৪জন নাতি-নাতনির সকলেই ছিলাম একসাথে, এক স্মৃতি রোমন্থনীয় অধ্যায়।
তিনি আমাদের জীবনে ছাতা হয়ে ছিলেন। দৈহিক ভাবে না হলেও আত্মিক ভাবে আজও তিনি আমদের উপর তাঁর রূহানী প্রভাব রেখে চলেছেন।
🌀ইতিহাসের অস্তাচলে হারিয়ে গেলেন আমার দাদা, যিনি আমার চেতনার বাতিঘড়, যার কাছে শিখেছি মেহমানদারী-আতিথেয়তা।
কেমন করে মানুষকে আপন করে নিতে হয়, কেমন করে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কেমন করে সরল জীবন যাপন করতে হয়।
ভালো মানুষ হবার শিক্ষা, মানবিক মানুষ হবার দীক্ষা। কতটুকো মাটির মানুষ হতে পেরেছি জানিনা, তবে কন্টকময় মুহুর্তে দাদার চারিত্রিক মাধুর্য হৃদয়ের স্ক্রীনে দোলা দেয় বারংবার, বহুবার।
🍒হে! মালিক পরওয়ার দেগার, তুমি আমার দাদা (রাহিমাহুল্লাহ) কে তোমার রহমতের চাদর দিয়ে ঢেকে রাখো।
আমীন….. ইয়া রাব্বাল আ’লামীন।